করোনাভাইরাসের ভীতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে মানুষ। কারণ বেশ কিছুদিন ধরে দেশে করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী ও মৃত্যু; দুটিই নিম্নমুখী। সর্বশেষ চার সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হারও ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, সংক্রামক ব্যাধি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে তখন এটি অন্যান্য সাধারণ রোগের মতোই গণ্য হবে। সে হিসেবে করোনাভাইরাসকে এখন অন্যান্য সাধারণ রোগের মতো একটি রোগ বলা যায়। করোনার নিম্ন সংক্রমণ হারের মধ্যেই স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড। টিকার প্রয়োগ করোনা নিয়ন্ত্রণে গতি বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস নির্মূলের পথে রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে- এটি স্বস্তির বিষয়। তবে বিপদ কেটে গেছে- এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। কারণ দেশে এখনও সংক্রমণ চলছে। ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে দুই থেকে তিন মাস নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সংক্রমণ আবার বেড়েছে। বাংলাদেশেও সে পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সতর্ক থাকতে হবে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিনা, বুঝতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে। সংক্রমণের সর্বশেষ সর্বোচ্চ পর্যায় অর্থাৎ পিক টাইম থেকে টানা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগী ও উপসর্গ রয়েছে এমন সন্দেহভাজন নূ্যনতম ৫০ শতাংশ কমে এবং অন্তত ৮০ শতাংশ সংক্রমণ একটি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারে হয়। নির্দিষ্ট ক্লাস্টার হলো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কাছাকাছি থাকা অনেকের মধ্যে সংক্রমণ। কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে নমুনা পরীক্ষার হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে এবং তিন সপ্তাহ ধরে মৃত্যু ও সন্দেহভাজন মৃত্যু কমতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা যাবে।
দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত বছরের জুন-জুলাই মাসে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। ওই সময়ে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজারের ওপরে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। জুলাইয়ের পর থেকে সংক্রমণ কখনও বেড়েছে, আবার কখনও কমেছে। গত ১০ সপ্তাহ ধরে নতুন রোগী শনাক্তের হার কমছে। সর্বশেষ চার সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হারও ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ দিন ধরে শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে থাকার পর গতকাল শনাক্তের হার ৩ শতাংশের কিছুটা ওপরে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো সর্বশেষ করোনা সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গতকাল সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮৭০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৮ হাজার ২৮৫ জন। সুস্থতার হার ৯০ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর মৃত্যুহার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিম্নমুখী- এটি স্বস্তির। এর মধ্যেই ১১ লাখের ওপরে মানুষ করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। ভারত থেকে দ্বিতীয় ধাপে আরও ৫০ লাখ টিকা চলতি মাসেই আসছে। প্রতিদিনই টিকাকেন্দ্রে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি নিরাপদ দূরত্ব মেনে আরও কয়েক মাস চলতে পারলে হয়তো করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত: জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিকা গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, এটি করতে পারলেই দেশ থেকে চিরতরে নির্মূল হবে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক সাহসী পদক্ষেপে অর্থনীতির গতি যেমন স্বাভাবিক রয়েছে, তেমনি করোনা নিয়ন্ত্রণেও সাফল্য এসেছে। যার সুফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সমকালকে বলেন, করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এই গতি ঊর্ধ্বমুখী কিন্তু একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির গতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কিন্তু করোনাকালে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে তা স্বাভাবিক ছিল। অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক রাখতে বেসরকারি খাতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক। এতে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠে বেসরকারি খাত। আর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি ছিল, করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই ৩১ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার। ওই ছুটি প্রত্যাহারের পর অফিস-আদালত খুলে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু হয়। অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক হতে থাকে। অথচ বিশ্বের অন্য দেশগুলো কিন্তু লকডাউনে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের সাহসী সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। অর্থনীতির গতি ধরে রাখার নীতিতে তিনি অবিচল ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাকালে সরকারের বিভিন্ন কাজ নিয়ে সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু ভালো পদক্ষেপগুলোও স্বীকার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষকে সচেতন করতে সরকারের ঘাটতি ছিল। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন নিয়ে সমন্বয়হীনতা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু সাহসী পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ করে অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক রাখতে তার দিকনির্দেশনা খুবই কার্যকর হয়েছে। একইভাবে শুরুতেই টিকা আনার ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন। বিশ্বের অনেক দেশে এখনও টিকার প্রয়োগ শুরু হয়নি। কিন্তু ৫৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এটি সত্যিই প্রশংসনীয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, শুরুতে একটি মাত্র কেন্দ্র আইইডিসিআরে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হতো। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারাদেশে নমুনা পরীক্ষার কেন্দ্র সম্প্রসারিত হয়। কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন কঠোরভাবে পালন করা হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। করোনাকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সভা করে নিয়মিত পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষি মন্ত্রণালয়কে খাদ্য উৎপাদনে তিনি দিকনির্দেশনা দেন। খাদ্য, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করে দিকনির্দেশনা দেন তিনি। একই সঙ্গে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলার ডিসি, এসপি, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও ভার্চুয়ালি কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। দেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা।
References: