প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে উপকূলীয় ও দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ

 একটা কথা মোটামুটি সবারই জানা, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের প্রথম সারিতে রয়েছে। আর দেশের মধ্যে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ, আঘাতপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় ও দ্বীপ এলাকাগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ সচেষ্ট। তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ধারণা হয় যে, এ সকল অভিঘাতের কারণে জাতীয় আয় ন্যূনপক্ষে এক থেকে দেড় শতাংশ কম হচ্ছে। অর্থাত্ বলা যায়, যদি এভাবে ক্ষয়ক্ষতি না হতো তাহলে গত বছর অর্থাত্ ২০১৫-১৬ সালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১১ শতাংশের স্থলে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি হতে পারত। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আরো ব্যাপক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্যই একাজে বাংলাদেশ এককভাবে এবং শুধু নিজস্ব সম্পদ দিয়ে বেশিদূর এগোতে পারবে না। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ মোটেই দায়ী নয়। মূল দায়িত্ব উন্নত বিশ্বের। এ ক্ষেত্রে তাই বাংলাদেশসহ অন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া উন্নত বিশ্বের দায়িত্ব। কিন্তু এখন পর্যন্ত নানা দেন-দরবার ও উন্নত বিশ্বের নানা অঙ্গীকার তেমন ফলপ্রসূ সহায়তায় রূপান্তরিত হয়নি। আন্তর্জাতিক এই দেন-দরবার অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে, জোরদার করতে হবে। কিন্তু আক্রান্ত ও বিধ্বস্ত মানুষ এবং ভেঙে-পড়া অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনর্বাসনে নিজস্ব সামর্থ্যে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ কার্যকরভাবে নেওয়া জরুরি। আর অবশ্যই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে প্রাপ্ত অর্থ-প্রযুক্তি যতটুকুই হোক তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটবে এবং পরে ঘুরে দাঁড়ানো জটিল ও কঠিন হয়ে উঠবে।
Disastar-1702
সম্প্রতি পিকেএসএফ-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জসীমউদ্দিনসহ আমি হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ (বিগত ১৬-১৯ জানুয়ারি ২০১৭) এবং পরে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপে (বিগত ২৯ জানুয়ারি-১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম স্থানীয় পর্যায়ে পরিদর্শন করতে যাই এবং এই এলাকাগুলোর মানুষের সঙ্গে তাদের সমস্যা ও সেগুলো নিরসনে করণীয় সম্পর্কে মতবিনিময় করি। মহেশখালী ও কুতুবদিয়া পরিদর্শনে পিকেএসএফ-এর এমডি মো. আবদুল করিমও ছিলেন। এই দ্বীপগুলোর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা এবং সেখানকার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করার ফলে তাদের মূল সমস্যাগুলোর চিত্র আমার কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে। লেখা পড়ে বা অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যা ও বাস্তবতার সম্যক উপলব্ধি সম্ভব নয়।

এই দ্বীপগুলোতে পরিদর্শন ও মত বিনিময়ের ফলে যে বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নজর দেওয়া উচিত সেগুলো আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। এই লেখায় শুধু আমি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। এসব এলাকার সর্বত্র যে সমস্যাটি খুবই গুরুতর তা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। নদী-নালা ও ভূগর্ভস্থ পানি উঁচুমাত্রায় লবণাক্ত। এই পানি পান করা বা গৃহস্থালি, কৃষি এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কাজেই গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টার দিকে নজর দেওয়া উচিত তা হচ্ছে প্রয়োজনীয় লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট অথবা গভীর নলকূপ বসানো। অনেক জায়গায় ৮-৯ শ’ ফুট নিচে না গেলে গভীর নলকূপের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় না। কোথাও কোথাও অবশ্য আরো কিছু কম গভীরেও ভালো পানি পাওয়া যায়। একটি গভীর নলকূপ থেকে ৮০ পরিবার পর্যন্ত বা ৩০০ থেকে ৩৫০ জন প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি নিয়মিত পেতে পারেন। আর তা বসাতে এক লাখ টাকার মতো খরচ হয়। অপরদিকে স্থানীয় পর্যায়ে ছোট আকারের একটি লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট বসাতে খরচ পড়ে ২০-২২ লাখ টাকা (যদি বিদ্যুত্ থাকে); আর সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হলে খরচ হয় ৪৪-৪৫ লাখ টাকা। যেখানে অনেক গভীরেও বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় না সেখানে এ ধরনের প্ল্যাণ্ট স্থাপন করা হচ্ছে। এই সাইজের প্ল্যাণ্ট থেকে ঘন্টায় ৮০০ থেকে ১,০০০ লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। জনপ্রতি আট লিটার হিসেবে ঘন্টায় ১০০ থেকে ১২৫ জনের জন্য পানি সরবরাহ করা যায়। বাস্তবতার আলোকে কিছু গভীর নলকূপ ও লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন বিভিন্ন উপকূলীয় ও দ্বীপ অঞ্চলে বসানোর ব্যবস্থা ইতোমধ্যে করেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজন আরো অনেক অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, নিঝুম দ্বীপে ৯টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতে অসংখ্য মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা প্রত্যেক ওয়ার্ডে একটি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। আমরা সরেজমিনে দেখে এসেছি যে, একটি নলকূপ থেকে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর মধ্যে ৮০টি পরিবার বা ৩৫০ থেকে ৪০০ ব্যক্তি প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি পেতে পারেন। কিন্তু আরো অনেক পরিবার বিশুদ্ধ পানি বঞ্চিত। প্রত্যেক ওয়ার্ডে আরো একটি করে গভীর নলকূপ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। তবে আরো নলকূপ অথবা লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট লাগবে। আশা করি সেদিকে সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নজর দিবে। নিঝুম দ্বীপ ছোট হওয়ায় এবং জনসংখ্যা ৬০ হাজারের মতো হওয়ায় সেখানে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা সমাধান তেমন কঠিন নয়। প্রয়োজনীয় আরো গভীর নলকূপ এবং লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট বসানোর ব্যবস্থা করতে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। হাতিয়ায় এটা সম্ভব নয়, সেখানকার বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানে বড় লবণাক্ততা-নিরোধ প্ল্যাণ্ট-এর প্রয়োজন যা পিকেএসএফ-এর পক্ষে স্থাপন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা জানি, পানিই জীবন এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই পিকেএসএফ-এর একটি অগ্রাধিকার হচ্ছে যেখানে যেখানে সম্ভব বিশুদ্ধ পানি-বঞ্চিত মানুষের প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে সামর্থ্যের স্বল্পতার কারণে পিকেএসএফ এক্ষেত্রে বেশিদূর যেতে পারে না।

একইভাবে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট বিদ্যমান। এই সংকট সমাধানে পিকেএসএফ সাধ্যমত চেষ্টা করবে। কুতুবদিয়ার কথা ধরা যাক। এই দ্বীপে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বাস। এখানে জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি ব্যাপক এলাকা প্লাবিত করে থাকে। গতবছর ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে এ দ্বীপের বেড়িবাঁধ অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। যখন এই বাঁধটি তৈরি করা হয় তখন এর উচ্চতা ৭ ফুট না করে ৫ ফুট করা হয়েছিল। তাই এখন যেহেতু পৃথিবীর উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে তাই জোয়ারের সময় বাঁধের উপর দিয়েও পানি ঢুকছে। আর যেখানে যেখানে বাঁধ ভেঙে গেছে সেখান দিয়ে তো পানি ঢুকছেই এবং বাড়িঘর ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি করছে। লবণাক্ত পানির এই দৈনিক আক্রমণের ফলে কৃষিজমি আর কৃষিজমি থাকছে না। এসব এলাকায় তাই লবণ উত্পাদন করা হচ্ছে। কাজেই এই দ্বীপের মানুষ এবং অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে যথাযথভাবে বেড়িবাঁধটি পুনর্নির্মাণ করা। চল্লিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বেড়িবাঁধ হতে হবে যথাযথভাবে উচ্চতা ও ঢালুসম্পন্ন এবং শক্ত। বর্তমান বাস্তবতা এবং আগামীর প্রাকৃতিক সম্ভাব্য বিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে বেড়িবাঁধটির উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি এর ঢালু যথাযথ হতে হবে কেননা খাড়া বাঁধে পানির আঘাত বেশি লাগে এবং দৈনিক জোয়ারের পানির আঘাত এটিকে দুর্বল করে ফেলে এবং বিভিন্ন স্থানে তা ভেঙে যায়। এছাড়া সব এলাকায় দারিদ্র্য ব্যাপক ও গভীর, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক অপ্রতুলতা এবং প্রকট বিদ্যুত্ সংকট রয়েছে। রয়েছে ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ বিষয়গুলোর দিকে যথাযথভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

পিকেএসএফ সাধ্যমতো বিভিন্নখাতে বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, অর্থকরী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কর্মসূচি এসব এলাকায় এর সহযোগী সংস্থাদের মাধ্যমে পরিচালনা করছে। হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপে যেমন দ্বীপ উন্নয়ন এবং অন্যান্য সহযোগী সংস্থা তেমনি কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে কোস্ট ট্রাস্ট, প্রত্যাশী ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। আমাদের পরিদর্শন-ভিত্তিক বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্নভাবে পিকেএসএফ-এর কার্যক্রম এই অঞ্চলগুলোতে জোরদার ও সম্প্রসারিত করা হবে এবং কিছু নতুন পদক্ষেপও নেয়া হতে পারে।

বাংলাদেশ বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এতে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার বিশদভাবে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। টেকসই উন্নয়নের একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না, সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দেশের সকল অঞ্চলের সকল মানুষ তাদের বাস্তবতার আলোকে যাতে কার্যকরভাবে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দেশের প্রত্যেক পরিবেশ-সংক্রান্ত অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল (যথা— উপকূল, দ্বীপ, চর, হাওর-বাঁওড়, পাহাড়, খরা-আক্রান্ত) এবং প্রত্যেক পিছিয়ে পড়া মানবগোষ্ঠীর (যথা— উপকূল-হাওর-বাঁওড়-দ্বীপচর-পাহাড়বাসী দরিদ্র মানুষ, প্রতিবন্ধী, দলিত-পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নারী কৃষি শ্রমিক) কিছু কিছু বিশেষ বিশেষ সমস্যা রয়েছে। সেগুলো অনেকক্ষেত্রে চিহ্নিত আছে এবং বাস্তবক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যাও সামনে আসতে পারে। এসব সমস্যার কার্যকর সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এই আঙ্গিক থেকে উপকূলীয় ও দ্বীপ অঞ্চলগুলোর মানুষের যে বিশেষ বিশেষ এবং প্রকট সমস্যা রয়েছে সেগুলো অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে সমাধান করতে হবে— যাতে এসব অঞ্চলের মানুষ দ্রুত দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারেন।

Source: http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/sub-editorial/2017/02/07/174195.html

About the author