লেখকঃ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(১৯ অক্টোবর ২০২৩, দৈনিক বাংলা)
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচন আর মাত্র সাড়ে তিন মাস পর অনুষ্ঠিত হবে। বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক তৎপরতা, এমনকি হস্তক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রধান ভূমিকায় রয়েছে। কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশও তৎপরতা দেখিয়ে আসছে।
তাদের এমন তৎপরতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে নিজেদের প্রভাব বিস্তার সুসংহত বা গভীর করা, নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সম্প্রসারণ করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্রতিহত করা আর যা কূটনৈতিক সুভাষণ হিসেবে সামনে আনা হয়েছে তা হলো বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে পরামর্শ ও সহায়তা দেয়া। অনেকের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে চীনের প্রভাব নস্যাৎ করা বা কার্যকরভাবে সীমিত করা। সেসব দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের আনাগোনা এবং সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আগামী নির্বাচন কেমন করে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করা যায় সে সম্পর্কে মতবিনিময় এবং পরামর্শ প্রদান চলছে। এমনকি ভালো নির্বাচন করার প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বাংলাদেশে আছে কি না সে রকম প্রশ্নও উত্থাপন করা হচ্ছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, তারা যেমন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়, সরকারও তাই চায়। তারা তাদের মতামত জনসমক্ষে এবং সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশ করে। এটা তো আমার বিবেচনায় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন করে অনুষ্ঠিত হবে সে দায়িত্ব তারা নিজেরাই তাদের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তারা বড়জোর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এবং বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন এবং তাদের পরামর্শ দিতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। ফলে যারা বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ বা বানচাল অথবা বিধিবহির্ভূত পদক্ষেপের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল নিজের করে নিতে পদক্ষেপ নেবেন তাদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। এ ছাড়া অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে যেগুলো কেমন হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। যেকোনো দেশের সরকার সে দেশে কাকে যেতে দেবে এবং কাকে যেতে দেবে না সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু দেশটির সঙ্গে বিবদমান নয় এবং ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এমন সব দেশের সঙ্গে সমনীতিভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটি প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে এসেছিল। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের তারা নানা প্রশ্ন করেছে এবং প্রাপ্ত উত্তর এবং নিজেদের পূর্ব ধারণাভিত্তিক তাদের মতামত সংবাদমাধ্যমে ব্যক্ত করেছে, যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের আওতায় পড়ে বলে আমার মনে হয় না। বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতাদের অনেকেই সব সময় ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ফলাফল ছলে-বলে-কৌশলে বা শক্তি প্রয়োগে নিজেদের পক্ষে নেয়ার নীলনকশা রয়েছে বলে এবং অন্যান্য বিষয়ে (রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক সংক্রান্ত অবিচার) বিদেশি বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে মিশনগুলোর কাছে এবং সময় সময় সেসব দেশের বাংলাদেশে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে নালিশ করে আসছে। মনে হয় যে, তারা যেন ধরে নিয়েছেন বিদেশিরা এ দেশে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় তা নিশ্চিত করে দেবে এবং তাদের এই কাজ করার ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে। এই নালিশ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নাগরিক সমাজের কিছু ব্যক্তি যুক্ত রয়েছেন। এরা সবাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অবমাননা করছেন। মনে হয় তারা যেন এখনো ঔপনিবেশিক মানসিকতায় ভুগছেন। তাদের একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রকৃতপক্ষে গৌরবরোধ করা উচিত এবং সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান এবং দেশের মানুষের উন্নতির জন্য তাদের প্রস্তাবগুলো জনগণের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে জনগণের মতামতের (ভোট) মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। যদি তাদের অবস্থান দেশ এবং জনগণের পক্ষে হয়, জনগণ একসময় তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে। সময় লাগতে পারে; কিন্তু এমন ঘটনা পৃথিবীর অনেক দেশে ঘটেছে।
আগেও ঘটেছে, তবে দেখা যাচ্ছে এবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি আগ্রহ অনেক তীব্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের আনাগোনার মিছিল বেশ কয়েক মাস ধরে চলমান রয়েছে। যারা এ দেশকে শাসন করতে চান তাদের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা ও গৌরব সমুন্নত রাখতে হবে। কোনো অবস্থায় লাখো শহীদের বীরত্বে প্রাপ্ত এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আমরা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের কবলে পড়তে পারি না এবং অবশ্যই অযাচিত বিদেশি হস্তক্ষেপকে মেনে নিতে পারি না আর তাদের আমন্ত্রণ করা তো নয়ই। সর্বোপরি এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন যার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছে সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রো হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হিমালয়তুল্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-পিতার দেশে আমরা কোনো অবস্থায়ই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারি না। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোতে দেশে যে অসাধারণ অর্থনৈতিক এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে অগ্রগতি হয়েছে তা সুসংহত করে বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলো (মূল্যবোধের অবক্ষয়, নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঘাটতি, সুশাসনে ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতে সমস্যা, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার এবং অন্যান্য) কার্যকরভাবে মোকাবিলা করে দেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাই আমাদের নিজেদের রাজনৈতিক সমস্যা নিজেরাই সমাধান করে, বিদ্যমান অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে সব নাগরিককে ন্যায়সঙ্গতভাবে অন্তর্ভুক্ত করে দেশকে এগিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার কাজ করা জরুরি। দেশের সব স্বার্থ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোনো বিদেশি শক্তি এখানে নাক গলাতে যেন না পারে সেদিকে কড়া নজর রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। সে লক্ষ্যে দেশে গণতন্ত্র সুসংহত করতে হবে, নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হবে এবং আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়ায় সবাইকে ন্যায্য-কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে দেশে টেকসই উন্নয়নের অব্যাহত ধারা নিশ্চিত করে কল্যাণ রাষ্ট্রের আঙ্গিকে ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে পারি এবং যথাসময়ে উন্নত দেশগোষ্ঠীর কাতারে শামিল হতে পারি।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ; চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়