লেখকঃ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(১৮ নভেম্বর ২০২৩, ইত্তেফাক)
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। চলমান হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচির ফলে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। স্বাভাবিক উত্পাদন-কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিপণনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। বর্তমানে বিরাজমান বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক গত অক্টোবর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫০ শতাংশ, যা বিগত প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ যতটা শ্রম দিতে পারে, রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতার ফলে মানুষের শ্রম দেওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়, ফলে উত্পাদনশীলতা অনেক কমে যায়। এছাড়া জীবনের ঝুঁকি তো রয়েছেই। নিশ্চিত করেই বলা যায়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর ও অশনিসংকেত।
একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সামাজিক উন্নয়ন, বিশেষ করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। দেশের স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু এই সময় হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়ছে। রাজনৈতিক আন্দোলন অবশ্য মানুষের স্বীকৃত রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু তা যদি হয় ধ্বংসাত্মক, তাহলে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতসমূহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব কর্মকাণ্ডে যোগদান করতে বাধ্য করা রাজনৈতিক পদ্ধতি হতে পারে না।
রাজনীতিবিদরা সব সময়ই বলেন, তারা রাজনীতি করেন জনগণের উন্নয়নের জন্য, তাদের স্বার্থ সমুন্নত করার জন্য, অর্থাত্ জনকল্যাণে। তাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম যদি দেশের অর্থনীতি ও দেশের মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, তাহলে তারা স্ববিরোধিতায় ও অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, সুস্থ রাজনীতিতে নন। আমার মনে হয়, সদিচ্ছা থাকলে সব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনীতিবিদরা জনকল্যাণে বা জনস্বার্থে রাজনীতি করছেন না, তারা রাজনীতি করছেন নিজেদের স্বার্থে, যেনতেনভাবে ক্ষমতার চেয়ারে বসার জন্য।
আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করেছি, সেগুলো তত্কালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন ছিল আমাদের হূত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অধিকার আদায়, অস্তিত্ব রক্ষা এবং দখলদারদের বিতাড়িত করে বাঙালির স্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এখন এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশে আমাদের আন্দোলনের বিকল্প পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে, যা সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে কিন্তু দেশের অর্থনীতির, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার কোনো ক্ষতি করবে না। মুক্তিকামী পরাধীন দেশের জনগণের রাজনৈতিক কর্মসূচি আর স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের কর্মসূচি কখনোই একরকম হতে পারে না। দেশের অর্থনীতিতে ও সমাজে সমস্যা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় বসতে কিংবা ক্ষমতার আসন রক্ষা করতে চাওয়াকে অপরাজনীতি বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যারা রাজনীতি করেন, তাদের এসব বিবেচনা ধারণ করা উচিত। বস্তুত বাংলাদেশে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে, ফলে সাধারণত ‘আমিত্ব’ই প্রধান, ‘আমরা’ বিবেচনায় নেই। নিজের সম্পদ, প্রতিপত্তি, পদ-পদবি বাড়াতে সবাই ব্যস্ত। আমার পথপরিক্রমায় অন্য কারো অধিকার ক্ষুণ্ন হলো কিংবা অন্য কারো সমূহ ক্ষতি হলো কি না, তা বিবেচনা করা হয় না। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
সুষ্ঠু টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশে একটি দেশের সব মানুষের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অর্থনীতির উন্নয়নসাধন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের অভিযাত্রার ভিত্তি ও ধারা কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, তা আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত। উন্নয়নের ধরন ও ধারা অবশ্যই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। লক্ষ্যসমূহ রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয় এবং বাস্তবায়ন ব্যবস্থাও রাজনৈতিক সরকার বিন্যাস করে থাকে। সব উন্নয়ননীতি ও কর্মসূচির লক্ষ্য হতে হবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রে রেখে। তাদের যথাযথ উন্নয়নই নিশ্চিত করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। সেই আঙ্গিকেই পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে; অর্থাত্ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশপ্রক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বিন্যস্ত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশে একটি বিষয় লক্ষণীয়, দেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেই আগের সরকারের আমলে গৃহীত উন্নয়নসংক্রান্ত সব নীতি পরিবর্তন করা হয় এবং অনেক প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। গৃহীত কোনো নীতি বা প্রকল্প যদি জনস্বার্থের অনুকূলে না হয়, তাহলে তা বন্ধ বা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আগের সরকার কোনো পদক্ষেপ বা প্রকল্প গ্রহণ করেছে বলেই যেমন করেই হোক, সেসব বন্ধ করতে হবে, এমন মনোভাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; কেননা তা দেশের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। সব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যথাযথভাবে ধারণ করলে এমন হওয়ার কথা নয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে গিয়ে যদি কেউ রাজনীতি করতে চান, তাহলে আমি বলব, সেটা কখনোই বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য রাজনীতি হতে পারে না। রাজনীতি দেশের সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে। আর বাংলাদেশের সেই রাজনীতি হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য একান্ত প্রয়োজন। বিগত এক যুগের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ যে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে, তার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করেছে একদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বহাল থাকা এবং জনোন্নয়ন উদ্দীষ্ট নীতিকাঠামো বিদ্যমান থাকা। অন্যদিকে সেই অনুকূল পারিপার্শ্বিকতায় দেশের কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যম ও শ্রম। তারা নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছেন এবং একই সঙ্গে দেশের উন্নতি হয়েছে। কোনো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যদি অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়, সেই দেশে উন্নয়ন-কার্যক্রম নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। কোনো দেশে যদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে, তাহলে সেই দেশে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশামতো ঘটে না এবং বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসে না। কারণ কেউই অস্থিতিশীল পরিবেশে বিনিয়োগ করার মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইবে না। ২০০৯ সাল থেকে এযাবত্ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটেছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। যদিও একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এখনো চিহ্নিত। সেই তকমা ঝেড়ে ফেলার কথা ২০২৬ সালে। লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। এই পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়েছে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতি-কৌশলের ধারাবাহিকতা বজায় থাকার কারণেই। ভবিষ্যতে আমরা যদি অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে চাই, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেই হবে। সরকার পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু গৃহীত উন্নয়ন-নীতিমালা ও কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। দেশ-বিদেশে পরিবর্তিত বাস্তবতার আলোকে এগিয়ে চলার পথে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন অবশ্যই করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান অভিঘাত মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় তত্পরতা আরো বাড়াতে হবে। তবে এক্ষেত্রে বিস্তর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। উন্নত বিশ্ব দ্রুত ও পর্যাপ্ত গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসারণ যেন কমিয়ে আনে সে বিষয়ে আরো সোচ্চার হতে হবে।
আমাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পূর্বাপর ভেবেই নিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কিছু ভালোভাবে বিবেচনা না করেই, হঠাত্ই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনেক সময় অকার্যকর ও ক্ষতিকারক হয়ে থাকে। আবার বাস্তবায়নেও অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। এখানে নানা চক্র কাজ করছে। আমাদের মূল্যবোধ জাগ্রত করা গেলে এবং অশুভ চক্রসমূহের কার্যক্রম বন্ধ করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আইন প্রয়োগ করে সব সমস্যা সমাধান করা যায় না। আইনের পাশাপাশি ব্যক্তির ইতিবাচক মনোভাব জাগ্রত করতে হবে। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ এবং চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস