(দৈনিক সমকাল, জানুয়ারি ১০, ২০২২) একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলে কাজ করি। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে খবর পাই- পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। খবরটি শুনে স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত হই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মনে আসে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। উল্লাসের মাঝেও বিষণ্ণতা চলে আসে।
এবার ভারত থেকে স্বাধীন দেশে ফেরার পালা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মুজিবনগর সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দেশে ফিরলেন ২২ ডিসেম্বর। ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমানে আমি ফিরে এলাম ৩১ ডিসেম্বর। সেদিন আরও ছিলেন এএইচএম কামারুজ্জামান, ড. মোশাররফ হোসেন ও জোহরা তাজউদ্দীন। ঢাকায় এসে পৌঁছলাম সন্ধ্যায়।
তখনও দেশে থমথমে ভাব। অনেকে ভয় ও শঙ্কার মধ্যে ছিল। কারণ পাকিস্তানি ও বিহারিদের কারও কারও হাতে তখনও বন্দুক ছিল। তারা মাঝেমধ্যে অঘটন ঘটাত। আমি এক আত্মীয়ের বাসায় এসে উঠলাম। প্রথমে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। দেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ তদারকি করেছি। রেড ক্রসের বিমানে দেশের নানা প্রান্তে সে কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়েছি।
তখন আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক; কিন্তু কারও মধ্যে উল্লাস ও আনন্দ নেই। কারণ তখনও আমাদের মুক্তি পূর্ণতা পায়নি। যার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি; যার আদর্শে মুক্তি ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন হলো, সেই অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। গোটা জাতি তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়।
আমরা ততদিনে জেনে গেছি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগারে তার জন্য কবর পর্যন্ত খনন করে রাখা হয়েছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। অবশেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডন, পরে ভারত হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে এলেন তিনি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সেই দিনটির কথা কখনও ভুলব না। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য মানুষের ঢল নামে। কতসংখ্যক মানুষ সেদিন রাস্তায় এসেছিলেন, তা হিসাব করে বলতে পারব না। দু’চোখ যতদূর যায়- মানুষ আর মানুষ! বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে আসতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। যেন ঢাকাজুড়ে মানুষের বাঁধভাঙা উল্লাস। এ অনুভূতি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দেশের অবিসংবাদিত নেতার আগমনে মানুষের মনে প্রাণ ফিরে এসেছিল।
এই রেসকোর্স ময়দানেই ৭ মার্চ ঐতিহাসিক জনসভায় উপস্থিত ছিলাম আমি। যখন তিনি বলেছিলেন- ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি/ তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’- আমার সমস্ত মন ও শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। ওই ভাষণের শেষদিকে যখন বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’; তখনই আমরা স্বাধীনতার বার্তা পেয়ে গিয়েছিলাম। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর নিদের্শের প্রতি সাড়া দিয়েছিলাম।
একই রেসকোর্সে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১০ জানুয়ারির জনসভার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু নিজেও আবেগে বারবার চোখ মুছছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ৃব্দত করে বললেন- কবিগুরুর কথা মিথ্যে প্রমাণ হয়েছে। বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। আবেগমথিত কণ্ঠে জানালেন, কীভাবে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বলেছিলেন- তার লাশটা যেন বাঙালির কাছে, বাংলাদেশের মাটিতে পৌঁছে দেওয়া হয়। আবেগে ভেসে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তিনি অন্যায়-অত্যাচার, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছিলেন। সবাইকে নিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলার কথা বলছিলেন।
রেসকোর্সে উপস্থিত জনতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আবেগ ও কান্না সংক্রমতি হচ্ছিল। তাদের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কেউ অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, কেউ কলম দিয়ে; কেউ আবার কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। অনেকে অত্যাচারিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন। অনেকে পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন; গৃহহারা হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই সবাই নতুন দেশের নতুন স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা যেন হারানো স্বজনের ফিরে আসা।
৭ মার্চের রেসকোর্সে ছিল মুক্তিকামী জনতার হিল্লোল। আর ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স দেখে মনে হচ্ছিল, শান্ত সমুদ্র। সমুদ্রের মতোই লোনাজলে ভেজা। সবাই চোখ মুছছে, কাঁদছে; কিন্তু তাদের মনের মধ্যে প্রশান্তি। যাক, এবার দেশের স্বাধীনতা ও বিজয় পূর্ণতা পেয়েছে। আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্ত ও স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছি।
লেখকঃ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: অর্থনীতিবিদ
News link: https://www.samakal.com/editorial-subeditorial/article/220192184/রেসকোর্সে-লোনাজলের-জনসমুদ্র