QK Ahmad expresses his childhood memories regarding Eid experiences to an interview with Bangla Newspaper “Dainik Samakal”
(Interview in Bengali) শৈশবের ঈদ ও ঈদের সাংস্কৃতিক বিবর্তন নিয়ে “সমকালে” ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এর সৃতিচারন মূলক সাক্ষাৎকার
পেছন ফিরে তাকালে মনে পড়ে, শৈশবে ‘ঈদ আসছে’ জেনেই আমাদের আনন্দ-উল্লাস শুরু হতো। ঈদ মানেই আমাদের কাছে ছিল প্রিয়জনদের কাছে পাওয়া। অনেক আত্মীয়-স্বজন এ উপলক্ষে বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। আমরাও যেতাম। আমার বাবা ছিলেন অবিভক্ত আসাম গণপরিষদের এমএলএ।
তার নির্বাচনী এলাকা ছিল তিনটি থানা নিয়ে। যে কারণে তিনি বেশিরভাগ সময় বাড়ির বদলে অপেক্ষাকৃত কেন্দ্রীয় ও শহরাঞ্চল বদরপুরে তার কার্যালয়ে অবস্থান করতেন। এ ছাড়া তিনি এমএলএ থাকা অবস্থাতেও বদরপুরে শিক্ষকতা করতেন। সেখানেই নির্বাচনী এলাকার মানুষ তার সঙ্গে দেখা করত। ঈদের আগে ও পরের বেশ কিছু দিনের জন্য তিনি গ্রামের বাড়িতে আসতেন। তাকে কাছে পাওয়াটা আমাদের পরিবারের, আত্মীয়-স্বজনের এবং গ্রামবাসীর জন্য ছিল বাড়তি আনন্দের ব্যাপার।
এ ছাড়া ঈদের সময় ছোটদের জন্য আরেকটি বড় আনন্দ ও উত্তেজনার বিষয় ছিল ‘নতুন কাপড়’। সবার জন্য নতুন কাপড় আনা হতো। সে সময় কোরবানি হতো বটে; কিন্তু সেখানে আমাদের ছোটদের কোনো ভূমিকা ছিল না। খুব মনে পড়ে, ঈদ উপলক্ষে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন হতো। আমরা ঈদের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে সেসব খেলাধুলা, কার কার বাড়ি বেড়াতে যাব_ এসব পরিকল্পনা করতাম দল বেঁধে। আমাদের শৈশবে ছোটরা সব দল বেঁধেই চলাফেরা করতাম। ঈদের সময়ও দল বেঁধেই গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি বেড়াতে যেতাম। এখন আর শিশু-কিশোরদের এভাবে চলাফেরা করতে দেখি না। এখন নতুন জামা-কাপড় কেবল নয়, কারটা কত দামি, দেশি না বিদেশি- এ নিয়েও রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। বিষয়টি কোনোভাবেই নির্মল আনন্দের অংশ হতে পারে না।
ম্যাট্রিক পাস করার পর আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ি সিলেটের এমসি কলেজে। পরে স্নাতক পড়তে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বাবা ও পরিবারের অন্যরা তখন থাকতেন মৌলভীবাজারে। দেশ বিভাগের পর তিনি সেখানকার কলেজে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু ঈদের সময় আমরা সবাই রাজনগরের বাড়িতে যেতাম। আত্মীয়-স্বজনরাও সেখানে আসত। সবাই মিলে ঈদ করতাম খুব আনন্দের সঙ্গে। আমরা যেহেতু গ্রামের বাড়ি থাকতাম না, সেখানকার সব কৃষি জমি বর্গাচাষিদের দেওয়া ছিল। নিজস্ব গরুও ছিল না। কোরবানি ঈদের কয়েক দিন আগে বাড়িতে গিয়ে আমরা তখন গরু কিনতাম। ততদিনে এসব দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়েছে।
কোরবানির মাংস তখন আমরা তিন ভাগ করতাম_ এক ভাগ নিজেদের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য, অপর ভাগ গ্রামবাসী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। কোরবানির পরপরই ভাগ করে বিতরণ করা হতো। একটা বিষয় তখন লক্ষণীয় ছিল, দরিদ্র মানুষরাও কোরবানির মাংসের জন্য কোথাও যেতেন না। বরং তাদেরকে ডেকে এনে এবং কখনও কখনও বাড়িতে গিয়ে পেঁৗছে দিয়ে আসা হতো। পুরো বিষয়টির মধ্যে একটা মর্যাদাবোধের ব্যাপার ছিল। এখন যেভাবে সারিতে দাঁড় করিয়ে মাংস বিতরণ করা হয়, সেটা আমাকে খুব পীড়া দেয়। অনেক সময় দেখেছি, লাইনে ঠিকমতো না দাঁড়ালে বকাঝকা করা হয় বা প্রহারও করা হয়। এই বিষয়টি কোরবানির মাংস সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার যে মর্মার্থ, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। এখন যেভাবে পুরো মাংস ফ্রিজে রেখে নিজেরা বছরভর খাওয়া হয়, সেটাও আগের দিনে কল্পনা করা যেত না।
অনেকে বলতে পারেন, শহরে দরিদ্র মানুষ বেশি বলে এমনটি হয়। আমার তা মনে হয় না। অন্তত ষাটের দশকের ঢাকা শহরেও এই সংস্কৃতি ছিল না। মূলকথা হচ্ছে, কোরবানির মাংস বণ্টনের ক্ষেত্রে যাকে দেওয়া হচ্ছে, তার মর্যাদার বিষয়টি দাতাকে মাথায় রাখতেই হবে। এর একটি সমাধান হতে পারে ঢাকা শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক সব কোরবানি এক স্থানে দেওয়া ও ব্যবস্থাপনা করা। তারপর দরিদ্রদের ভাগ একত্র করে ওই ওয়ার্ডে যারা থাকেন, তাদের ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেওয়া। তাহলে যেমন অব্যবস্থাপনা কমবে, তেমনই বিষয়টি মর্যাদাকর হবে। একটি নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি হওয়ায় গলিতে গলিতে রক্ত ও বর্জ্যও থাকবে না।
ঈদের মতো সার্বজনীন উৎসবে আর যে বিষয়টি এখন আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়, তা হলো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। আগের ঈদ মানেই সবাই মিলে একত্র হয়ে আনন্দ, দেখা-সাক্ষাৎ করা। এখন সবাই নিজে নিজে উদযাপন করতে চায়। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে ঈদ পার করতে চায়। তাহলে এটা ‘সার্বজনীন’ উৎসব হয় কীভাবে?
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি ও আমার স্ত্রী যেহেতু দুই পরিবারের বড় সন্তান; ঢাকায় বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজন ঈদের দিন আমার বাড়িতেই জমায়েত হতো। সবাই মিলে আনন্দ করতাম। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হলো ঈদের দিন নয়, পরের দিন একেক বছর একেক জনের বাসায় মিলিত হবো। তারপর দেখা গেল, এটা একজনের ওপর চাপ পড়ে। ফলে ঠিক হলো, সবাই মিলে ঢাকার বাইরে কোনো অবকাশ বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘুরতে যাব। ৭০-৮০ জনের একটি গ্রুপ সারাদিন আনন্দ করে, খাওয়া-দাওয়া করে, আড্ডা দিয়ে ফিরে আসা। গত বছর পরিকল্পনা করতে গিয়ে দেখা গেল, ১০-১৫ জন ছাড়া সবাই নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। ফলে সামষ্টিক কর্মসূচি স্থগিত। এবার পরিকল্পনাই করা হলো না!
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আরেকটি প্রবণতা বেড়েছে। তা হলো, ঈদের ছুটিতে বিদেশে ঘুরতে যাওয়া। এমন সব দেশে যাওয়া, সেখানে ঈদের উৎসব নেই। এমনকি কোথাও কোথাও ঈদের নামাজের ব্যবস্থাও নেই। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এভাবে ঈদ উদযাপনের অর্থ কী? ঘুরতে তো অন্য সময়ও যাওয়া যায়! এটা আসলে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ। আমাদের প্রাচ্যীয় উৎসবের মর্মার্থ হচ্ছে সামাজিকতা। নিজের শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া। নিজের সংস্কৃতির নবায়ন। বিচ্ছিন্ন হয়ে ঈদ উদযাপন আসলে সংস্কৃতি ও শিকড় থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। আর শিকড় ছিঁড়ে গেলে কিছুই থাকে না।
রাজনগর পোর্টিয়াস হাই স্কুলে আমাদের বাংলা পড়াতেন মনোহর আলী স্যার। তিনি প্রায়শ ক্লাসে একটি কবিতার লাইন বলতেন_ ‘তোর নিজস্ব সব দিলেন দাতা আপন হাতে/ মুছে সেসব মেকি হলি, গৌরব কিছু বাড়ল তাতে?’ কবির নাম পরে অনেক খুঁজেও পাইনি। কিন্তু কথাটি অনেক মূল্যবান। আজকের দিনে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
Source: http://www.samakal.net/2014/10/05/90563
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০১৪
শিরোনামঃ ঈদের সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও শিকড়ের সম্পর্ক: ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ