ডঃ কাজী খলীকুজ্জমান এর অর্থনৈতিক কলাম।
প্রকাশঃ ০৩ এপ্রিল ২০২০, ঢাকাটাইমস।
দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে কৃষকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চলমান সংকটকালে কৃষক যেন তার উৎপাদিত ফসল ঠিকভাবে ঘরে তুলতে পারে। বিশেষ করে কৃষক যেন ধান কাটতে গিয়ে শ্রমিক সংকটে না পড়েন। স্বাস্থ্য বিধি মেনে তারা যেন মাঠে থাকেন। আর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দামও যেন তারা পান সেই ব্যবস্থাও করতে হবে।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে দেশের কৃষকদের নিয়ে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভাবার পরামর্শ দিয়ে এই কথাগুলো বলেছেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের ( পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষি সেক্টরে বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকা টাইমসের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্বাধীনতা পুরষ্কারজয়ী এই কৃতী অর্থনীতিবিদ।
কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ‘প্রয়োজনে সরকার শ্রমিকদের যেন পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী দেয় আর উৎপাদিত পণ্য পরিবহনেরও ব্যবস্থা করে। কৃষককে যেন বীজসহ সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হয়। এখানে প্রনোদনারও প্রয়োজন আছে।’
‘এজন্য খুব দ্রুত তথ্যভিক্তিক পরিকল্পনা করে কাজে নেমে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে কৃষি এবং গ্রামে যে কৃষি বর্হিভূত কাজ হচ্ছে তার জন্য আমাদের প্রবৃদ্ধির ভিতটা শক্ত আছে।’
ড. খলীকুজ্জমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ব্যপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেগুলো কৃষিমন্ত্রীকে বলেছেন, সেগুলো ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যেখানে যেটা দরকার সেখানে নজর দিতে হবে।’
‘এপ্রিল থেকেই আসছে আগাম বোরো। মে– জুন মাসে সারা দেশজুড়ে বোরো ধান কাটা হবে। আমাদের চালের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ আসে বোরে থেকে। বোরোর দিকে বেশি করে নজর দিতে হবে।’
বোরোধানের বিষয়ে কয়েকটি দিক লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দিয়ে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘এই বোরোর দিকে নজর দেয়ার কতগুলো দিক আছে একটা হলো, যখন ফসল তোলা হয় তখন দেখা যায় অনেক সময় বাজ (বজ্রপাত) হয়, এই ভয়ে শ্রমিক পাওয়া যায় না। গতবছর দেরিতে ফসল কাটা হয়েছে। এবার যোগ হচ্ছে অন্য (করোনা) সমস্যা, সুতরাং এখানে খেয়াল রাখতে হবে, ফসল তোলাটা নিশ্চিত করতে হবে।’
‘এটা কীভাবে করা যায়, তার জন্য যা যা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন সেটা সরকারকে করতে হবে। শ্রমিক যদি ভয়ে ফসল কাটতে না যায় তাদের কীভাবে নেয়া যাবে সেটা পরিকল্পনা করতে হবে। এবং সেটা যেন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে করা হয়। সেটা আগে থেকেই চিন্তা করে ঠিক করতে হবে। বোরোর ব্যপারে এটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আমি মনে করি।’
ফসল উৎপাদন পরবর্তী সরবরাহজনিত সমস্যার জন্য কৃষক যেন বিপাকে না পড়েন সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে জানিয়ে কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ‘সরবরাহ চেইন সচল রাখতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল যেখানে যেমন প্রয়োজন সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘দেখা যাবে অনেক কৃষকের কাছে হয়তো ভাল বীজ নেই সেটা তাকে দিতে হবে। তারপর অন্যান্য উপকরণ লাগবে সেই উপকরণ কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এবং পৌঁছে দেয়ার জন্য যানবাহন লাগবে। সাধারণ যানবাহনে হবে না। এটা যাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কিছু নিয়ম কানুন আছে সে নিয়ম কানুন মেনে। সেগুলো আগে থেকে চিন্তা করতে হবে। আগে থেকে এসব বিষয় যদি ঠিক করে রাখা না হয় তাহলে আমাদের বীজ থাকলেও সেটা হয়তো পৌঁছানো যাবে না।
কৃষককে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে তাদের যার যা প্রয়োজন সেটা দেয়ার পরামর্শ দিয়ে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে এ তথ্যটা তো জানতে হবে কার কী নেই, কার কোনটা লাগে, কোথায় লাগে। সেটা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। হাতে তো সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি তথ্য সংগ্রহের কাজটা শুরু করতে হবে।
‘কারও হয়তো বীজ নেই, বীজ লাগবে। কারও হয়তো বীজ আছে, কিন্তু পানির ব্যবস্থার সমস্যা আছে । সেই সমস্যা সমাধান করতে হবে। মোটকথা যার যেটা লাগে সে ব্যবস্থা করতে হবে। উপকরগুলো কীভাবে পৌঁছে দেয়া যায় সেইটার ব্যস্থা করতে হবে।’
কৃষককে বিনা সূদে ঋণ দেয়ার বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়েও আলোকপাত করে পিকেএসএফ চেয়ারম্যান বলেন, ‘ধান উঠলে ওই সময়ে কৃষক যাতে হুট করে সব বিক্রি করে না দেয় সেই জন্য তাদেকে সহজ শর্তে বা বিনাসুদে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করার দরকার হবে। এটা করা হলে কৃষক ধান সংরক্ষণ করে পরে বিক্রিতে উৎসাহিত হবে। তারা ধানের ন্যায্য দাম পাবেন। কৃষিকাজ করার জন্যও এ ঋণের দরকার হতে পারে। এছাড়া সরকারকে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা বাড়াতে হবে।’
সরকারকে সার্বিক বিষয়ে তথ্য নিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সব তথ্য সরকারের কাছে থাকার কথা না। কারন সমস্যা তো মাত্র ঘটেছে। এই তথ্য জোগাড় করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। আমরা যদি সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে চাই এটা করতে হবে। বোরোতে যদি মার খাই তাহলে কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে।’
করোনার প্রভাবে অনু-উদ্যেক্তাদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হবে মন্তব্য করে কাজী খলিকুজ্জমান বলেন, ‘সারা দেশে মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ প্রচুর হয়েছে। এটাতে একটা বড়ভাবে ধাক্কা লাগবে। এখানে সরকারকে নজর দিতে হবে। এসব উদ্যোক্তাদের তাদের ঋণ নিয়েই ব্যবসা শুরু করে। তাদের হয়তো ঋণ আদায়টা পিছিয়ে দিতে হবে। আরও ঋণ লাগলে সেটা তাকে সহজ শর্তে দিতে হবে। এমনকি অনুদানও দেয়া দরকার। বড়-বড়দের না দিয়ে এমন ছোট উদ্যোক্তাদের অনুদান দিতে হবে।’
‘ছোট-ছোট উদ্যোক্তা আছে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, তাদের তথ্যও বেশি নেই। কিছু তথ্য আছে আমাদের কাছে, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের কাছে যে তথ্য আছে, এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে তথ্য আছে, সেসবের ভিত্তিতে কাজ করা দরকার। এসব উদ্যেক্তারা স্বাভাবিকভাবে যেন চলতে থাকে অথবা যে অবস্থায় আছে সেটা যেন ধরে রাখতে পারে। আমাদের প্রবৃদ্ধি যে হয় সেটার ভিতটা কিন্তু গ্রামীন অর্থনীতিতে। গ্রামের কৃষি এবং কৃষিবর্হিভূত কাজের ভিতটা শক্ত আছে সেজন্য।’
বাংলাদেশের জনগনের ভেতরে বিপদে ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি আছে মন্তব্য করে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘করোনার প্রভাব কতদিন থাকবে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। এই ভাবেই যদি চলে তাহেল অত বেশি ক্ষতি হবে না, আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে যেতে পারবো। আমরা বাংলাদেশিদের মধ্যে একটা আন্তঃশক্তি আছে, আমরা এমন দুঃসময়ে ঘুরে দাঁড়াই। আমাদের সবাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, সচেষ্ট থাকে, এটাই বড় শক্তি।’
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই এক হয়েছিল; ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও সবাই এক হয়েছিল। এইবারও আমি আশা করছি এভাবে সবাই এগিয়ে আসবে, সচেতন থাকবে। সরকারি প্রনোদনা যেটা আছে সেটা তো আছেই। যে কাজগুলোর কথা আমি বললাম সেটা সরকার বা তার প্রতিষ্ঠানকে এখনই শুরু করতে হবে।’
পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান বলেন, ‘এগ্রিকালচার এক্সটেনশন আছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) আছে। তারা এ কাজগুলো করবে।’
‘বাংলাদেশের মানুষ বিপদে একে অন্যেকে সহায়তা করে। এবারো সবাই মিলে সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো। আর এজন্য খুব দ্রুত পরিকল্পনা এবং তথ্যভিক্তিক পরিককল্পনা করে কাজে নেমে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
(ঢাকাটাইমস/০১এপ্রিল/জেআর/ডিএম)