এলডিসি থেকে উত্তরণ: প্রশ্নটা আত্মমর্যাদার (সমকাল কলাম)

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এর কলাম “এলডিসি থেকে উত্তরণ: প্রশ্নটা আত্মমর্যাদার” (সমকাল, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১)
জাতিসংঘের বিচারে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) পাঁচ দিনের বৈঠক শেষে শুক্রবার এই সুপারিশ করেছে। প্রথম দফায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এলডিসি থেকে বের হতে সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেতে হয়। স্ব্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রস্তুতির জন্য সাধারণত তিন বছর এলডিসি হিসেবে থাকে একটি দেশ। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। তার নেতৃত্বেই গত এক যুগের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এই উত্তরণে ভূমিকা রেখেছে।

অবশ্য স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত রাষ্ট্রের যে বিভাজন, তা আমার কাছে মেকি মনে হয়। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কিছু দেশ নানান সমস্যায় জড়িত থাকায় এগিয়ে যেতে পারছিল না। ওই দেশগুলোকে এগিয়ে নিতে বিশেষ সহায়তার প্রয়োজন ছিল। জাতিসংঘ সে লক্ষ্যেই স্বল্পোন্নত ধারণাটি সামনে আনে। যাতে ওই দেশগুলোকে বিশেষ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্য সুবিধা, উন্নয়ন সুবিধা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ছাড়ে, সহজ শর্তে ঋণ বা অনুদান দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সব দেশই উন্নয়নশীল, সবাই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে, আর কেউ এগিয়ে যেতে পারছে না। আবার কোনো দেশ কখনও এগিয়ে যাচ্ছে, কখনও পিছিয়ে পড়ছে। মোটের ওপর সব দেশই উন্নয়নশীল। এমনকি উন্নত দেশগুলোও কোনো কোনো অর্থে উন্নয়নশীল। স্বল্পোন্নত শব্দটি অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য শব্দ নয়। এর সঙ্গে সম্মান ও ভাবমূর্তির বিষয় জড়িত। পৃথিবীর কয়েকটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি নেয়নি। মোট ৪৮টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এর সুযোগ-সুবিধাগুলো পেয়ে আসছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলো হলো- মাথাপিছু আয়, মানব সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে এবং ২০২১ সালে সব শর্ত পূরণ করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ বলছে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশ চাইলে আগামী তিন বছর বা ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হতে পারে, আর তা না হলে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক যে অবস্থান তাতে তাকে স্বল্পোন্নত দেশ বলার অবকাশ নেই। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত রাষ্ট্রের যে বিভাজন, এর চেয়ে অর্থবহ বিভাজন হলো স্বল্প আয়ের দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ ও উঁচু আয়ের দেশ। এই বিভাজন স্পষ্ট করে কোন দেশ কোন অবস্থানে রয়েছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ কয়েক বছর আগে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে। এখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের দিকে। আশা করা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এ লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবো।

পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচিতি এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। বিগত কয়েক বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের ওপরে, এরপর তা সাত শতাংশে এবং সর্বোচ্চ তা ৮ দশমিক দুই শতাংশে উন্নীত হয়েছে। করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি চার শতাংশে নেমে এলেও পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো রয়েছে। সামান্য কিছু দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৫ সালে ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’ বলেছিল- ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন ও ব্রাজিলের মতো বাংলাদেশও অগ্রগতি সাধন করবে। সেটা ছিল সম্ভাবনার কথা, তবে আমরা সেটা অর্জন করতে পারিনি। বলা হয়েছিল- ব্রিকসের পর এগারোটি দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্ষম হবে। সেই ১১টি দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। বর্তমানে ডলারে জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। অতি সম্প্রতি সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) নামে যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেছে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক দেশকে পেছনে ফেলে ২৫তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।

বাংলাদেশ এখন পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে নিজস্ব অর্থায়নে। আমরা দারিদ্র্য বিমোচন করেছি উল্লেখযোগ্য হারে। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শিক্ষায় যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমেছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে সফল রাষ্ট্র। সুতরাং এতসব অর্জনের পর বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ খুবই স্বাভাবিক। জাতিসংঘ কিন্তু বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বানিয়ে দিচ্ছে না। বরং এ অর্জন বাংলাদেশের, জাতিসংঘ শুধু কিছু হিসাব-নিকাশ রাখছে মাত্র।

আমি বরাবরের মতোই বলতে চাই, ২০২১ সালে আমরা নিজেরাই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। ইচ্ছা করলে আরও তিন বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় এ অবস্থানে থাকা যাবে। বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে কিছু কিছু হিসাব করা হয়।

অনেকেই মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে এলে আমরা স্বল্প সুদে ঋণ পাব না, সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে অনুদান দেওয়া হয়, সেগুলো থেকে বঞ্চিত হবো ইত্যাদি। একটি হিসাবে দেখেছিলাম, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে এলে আমাদের দুই বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি হবে, যা বাংলাদেশের জন্য খুব বড় কোনো ক্ষতি নয়। আমি মনে করি, আত্মমর্যাদার দিক বিবেচনা করে আমরা যদি এখনই বেরিয়ে আসি তাহলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে এর জন্য কয়েক বছর আগে থেকে এর জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল তা নেওয়া হয়নি। সেই প্রস্তুতির জন্য কিছু সময় নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আমরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো এগিয়ে নিতে পারি।

আমরা দেখেছি, স্বল্পোন্নত দেশ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তৈরি পোশাককে শুল্ক্কমুক্ত করেনি, শুধু ইউরোপে আমরা কিছু সুবিধা পাচ্ছি। আমরা তৈরি পোশাকের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ সংকট। ওষুধ শিল্পের বিস্তৃতি, কৃষিপণ্য রপ্তানিসহ অন্যান্য শিল্পের দিকে নজর দিতে হবে। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ এবং অন্যান্য শিল্পের অগ্রগতিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি। এছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেনদরবার করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়াতে হবে। এসব প্রস্তুতির বেশ কিছু নেওয়া হয়েছে, তবে আরও অনেক বাকি রয়েছে। দ্রুত সেই প্রস্তুতিগুলো সম্পন্ন করে ২০২৪ সালের আগেই ‘স্বল্পোন্নত’র তকমা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে আমরা এখন প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এই তকমা নিয়ে থাকার কোনো যৌক্তিকতা আমাদের নেই।

 

References:

About the author