এবার হোক দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বাজেট (সমকাল কলাম)

(কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এর কলাম, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯শে মে, ২০২১)

বাজেট একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণা করা হয়। অর্থনীতির আকার সম্প্রসারিত হওয়ায় আমাদের বাজেটের আকারও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বৃদ্ধি হবে- এটাই স্বাভাবিক। কারণ এ বছর অনেক নতুন ইস্যু সামনে থাকবে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনর্বাসনে জোর দিতে হবে।
আমরা জানি, স্বাভাবিক সময়ে বাজেটে এক ধরনের ধারাবাহিকতা থাকে। বাজেটে বিভিন্ন খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার সঙ্গে ওই খাতের আগামী বছরের বাজেটের অনেকখানি মিল থাকে। নতুন করে কোনো কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেওয়া হলে সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়ে যায়। এটাও বলতে হবে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা ও বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় কিছু নতুনত্ব এসেছে। নারীর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে; পরিবেশ এবং জলবায়ুর জন্যও আলাদা বাজেট থাকছে। এর ইতিবাচক প্রভাব সামনের দিনগুলোতে আরও স্পষ্ট হবে।
মনে রাখতে হবে, বাজেট ঘোষণার প্রক্রিয়ার চেয়ে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, গত বছর যখন বাজেট ঘোষণা করা হয়, তখনও করোনা পরিস্থিতির কারণে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কৃষি খাত ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। কিন্তু এবার আমরা দেখছি, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সামান্য বেড়েছে। সেখানে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার জন্য। স্বাস্থ্য খাতে যেসব সংকট আছে সেগুলো দূর করতে আসন্ন বাজেটেও বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
অতীতে বৈশ্বিক পর্যায়ে দেখা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছিল। সে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বিশ্বযুদ্ধের পরে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা শুরু করে যুক্তরাজ্য। এর পর এসেছিল সর্বজনীন শিক্ষা। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা সর্বজনীন করে তোলার মাধ্যমে তারা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। আমি মনে করি, কভিড পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা শুরু করতে পারে। আশার কথা, গত বছরই বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তোলার কথা অনেকেই বলেছেন। দেশজুড়ে আমাদের যেসব কমিউনিটি ক্লিনিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এবারের বাজেটে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা ও বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।
আমি মনে করি, আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে আরও কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা তো বললামই। শুধু কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজনে নয়; ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার স্বার্থেও। কভিডের সংক্রমণ থেকে মানুষকে তো বাঁচাতে হবেই। এ ধরনের আরও প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে। সে ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। কভিড মোকাবিলায় আমাদের দক্ষতা অনেক বেড়েছে, তবে সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। আর এ বাজেটে যেন কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে কেন্দ্র করে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বড় বাজেট রাখা হয়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বাজেটে কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার আগে থেকেই কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে এবং সম্ভব বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। কৃষি উন্নয়নে সরকার যান্ত্রিকীকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই যুগোপযোগী। পাশাপাশি যান্ত্রিকীকরণের কারণে যারা কর্মহীন হচ্ছে বা হবে তাদের পুনর্বাসনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

তৃতীয়ত, কৃষির বাইরে সারাদেশের ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র শিল্প এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান কোনোমতে টিকে আছে। ১৩এপ্রিল ২০২০ কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও কুটির ও অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পৌঁছে স্বল্পই। ব্যাংকের মাধ্যমে এগুলোর কাছে পৌঁছা যায় না। তবে এছাড়া সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয় সরাসরি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সফলতা বেশি হয়েছে। আমার প্রস্তাব, আসছে বাজেটে এ সকল কর্মকাণ্ডের জন্য ন্যূনপক্ষে ৩ শতাংশ (১৮ হাজার কোটি টাকা) বরাদ্দ দিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, বাংলাদেশ রুরাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পুরো অর্থ তাদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানগুলো যত ভালো করতে পারবে তাদের তত বেশি কাজে লাগাতে হবে। এতে এ খাতের উদ্যোক্তারা কিছুটা সুবিধা পাবেন। মনে রাখতে হবে, কৃষি ও অকৃষি খাত (ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা) ঘুরে দাঁড়ালে আমাদের গোটা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ প্রশস্ত হবে।

চতুর্থত, শিক্ষার ওপর আমাদের বর্তমান-অতীত নির্ভর করছে। করোনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে গেছে। অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তা খুব বেশি কাজে আসেনি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজ এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে। তারা কত দিনে এবং কীভাবে এ কাজ করবে, তার পরিকল্পনা করছে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ দরকার। বাজেটে যেন এ বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়।

পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গত বছর বাজেট থেকে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ বছরও যেন এ খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বাজেটে শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না; বাস্তবায়নের দিকেও নজর দিতে হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রায় ১০ মাস অতিবাহিত হলেও বাজেটের অর্ধেকও বাস্তবায়ন করা যায়নি। আগামী বছর যেন বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ করা হয়। বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে বছরের প্রথম দিকে। বছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়া করে বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে কাজ ভালো হয় না। ফলে সেখানে ঝুঁকির আশঙ্কা থেকে যায়।

বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্পদ আহরণ তথা আয়করসহ অন্যান্য কর আদায় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে জিডিপি ও আয়করের অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশ, যা নেপালে ১৭ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে ধনী হওয়ার হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রণোদনা চাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই প্রণোদনার অর্থ আসছে সাধারণ মানুষের দেওয়া কর থেকে। ফলে প্রণোদনা তাদেরকেই দিতে হবে, যারা সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। সে অনুপাতে বাড়ছে বাজেটের আকার। একই সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো না গেলে উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান বাংলাদেশের গতি শ্নথ হয়ে যেতে পারে। চলমান কভিড পরিস্থিতি এবং অনাগত দিনগুলোতে এই দক্ষতা ও সক্ষমতার গুরুত্ব আরও বাড়তেই থাকবে।
অর্থনীতিবিদ

Reference:

About the author