লেখকঃ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
(০৯ আগস্ট ২০২৩, ইত্তেফাক)
পৃথিবী দ্রুত অতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে, বরফ গলছে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নানা মাত্রায় অহরহ ঘটছে। যখন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার মধ্যে এ বছরের (২০২৩) জুলাই মাস ছিল সবচেয়ে উষ্ণ। বিশ্ব এতটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রধান কারণ হলো বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান গ্রিনহাউজ গ্যাস জমা হওয়া; বিশেষ করে বর্তমানে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জীবাশ্মনির্ভর ব্যাপক শিল্পায়ন, পাশাপাশি যোগাযোগ ও অন্যান্য খাতের বিকাশের কারণে প্রচুর পরিমাণে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাস। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ কমানোর জন্য তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো গৃহীত হয়নি। ফলে এই সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (আইপিসিসি) গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ ও এর প্রশমন (গ্রিনহাউজ নিঃসারণ কমানো) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার বিষয়ে সময় সময় বিরাজমান বাস্তবতা নির্ধারণে ১৯৮৮ সাল থেকে কাজ করে আসছে। বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই সংস্থা কাজ করে। আমি একসময় এই সংস্থার একজন প্রধান প্রণেতা ছিলাম।
আইপিসিসি সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে বিশ্বের সর্বত্র গবেষণালব্ধ তথ্যাদি রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করে এবং প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আঙ্গিকে বাস্তবে কী ঘটেছে এবং কী কী ঘটতে পারে আগামী দিনে তা তুলে ধরে। সম্প্রতি প্রকাশিত আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়নের ওয়ার্কিং গ্রুপ-১-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে যে গ্রিনহাউজ গ্যাস পুঞ্জীভূত, তার পরিমাণ দুই মিলিয়ন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। স্মর্তব্য, জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে (২০১৫) এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রথম শিল্পবিপ্লবের (১৭৬০) পূর্বের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেক কম এবং সম্ভব হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। আইপিসিসির উপর্যুক্ত প্রতিবেদন আরো বলছে যে, ২০৩০ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ঘটে যেতে পারে। একই মূল্যায়নের ওয়ার্কিং গ্রুপ-২-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মাত্রায় উষ্ণায়ন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, স্বাস্থ্যহানি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে। ঘন ঘন এবং ক্রমান্বয়ে অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি (আর্থসামাজিক, অবকাঠামোগত) ঘটিয়ে অবস্থা দিনে দিনে আরো জটিল করে তুলছে। চলতি দশকের মধ্যে যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা থেকে পরিত্রাণ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।
প্রাক্কালন করা হয়েছে যে, প্রতিটি দেশ যদি তাদের অঙ্গীকারকৃত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ কমানো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে, তবু পৃথিবীর উষ্ণতা এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ ২ দশমিক ৮ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক বৃদ্ধি ঘটে যেতে পারে!
আমরা প্রতিনিয়তই পৃথিবীর সর্বত্র জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান বিরূপ প্রভাব প্রত্যক্ষ করছি। বাংলাদেশে এখন ঘন ঘন নানা ধরনের (ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টি প্রভৃতি) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে।
পৃথিবীতে ৫৫টি দেশ বর্তমানে বিশেষভাবে জলবায়ু ভঙ্গুর দেশ হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ এগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং অধিক ভঙ্গুর দেশ হিসেবে প্রথম সারিতে রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশটি তিনটি বৃহত্ নদী অববাহিকার নিম্নে অবস্থিত, যথা:গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা। উজানে অধিক পানি উত্তোলনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে দেশে পানি প্রবাহের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ার কারণে ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাস হয়। উপকূলবর্তী এলাকায় লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটছে ব্যাপকভাবে। ফলে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং ফসল উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লবণাক্ত পানির সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। ব্যাপক নদীভাঙন ঘটছে প্রতিনিয়ত। ফলে অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। তারা অনেক সময় স্থানচ্যুত হয়ে শহরে এসে বস্তিবাসী হতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে আগেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটত, কিন্তু এখনকার মতো এত ঘন ঘন নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, এর জন্য কে বা কারা দায়ী? জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বা এ ধরনের উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ করে খুবই কম। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মোটেই দায়ী নয়। ১৭৬০-এর দিকে স্টিমভিত্তিক প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হলে বর্তমানে উন্নত দেশগুলো পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ করতে থাকে। পরে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব পর্যায়ে (১৮৭০-) বিদ্যুত্ ছিল মূল চালিকাশক্তি। উভয় ক্ষেত্রে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণকারী জীবাশ্ম মূল উত্স। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশও শিল্পায়ন শুরু করে। আগেই বলা হয়েছে, শিল্পায়ন ছাড়াও আরো নানাভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়।
উন্নয়নের লক্ষ্যে অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলেই পৃথিবী ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে সার্বিক বৈশ্বিক কার্যক্রম এখনো সীমিত। এছাড়া রয়েছে পরিবেশের অবনমন যথা: জীববৈচিত্র্য সংকোচন, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, গাছ কাটা, পাহাড় কাটা ইত্যাদি। সংশ্লিষ্টরা সচেতন হলেই এসব ক্ষেত্রে অবনমন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। কিন্তু সে রকম সচেতনতা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। এক কথায় বলা যায়, মানুষের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের অভাবের কারণেই আমরা এ ধরনের দূষণের শিকারে পরিণত হচ্ছি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জলবায়ুভঙ্গুর ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়াও দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ (কয়েকটি শহররাষ্ট্র ছাড়া)। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ বাস করছে। ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারের সাড়ে ৪০০ মানুষ বাস করে। পাকিস্তানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩০০-এর মতো, চীনে ১৫০ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪৮ জন মানুষ বাস করে। এই সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ এবং কানাডায় ৪ জন। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে অন্যান্য দেশের তুলনায় (সমমাত্রার দুর্যোগের ক্ষেত্রে) বাংলাদেশে প্রভাব পড়ে অনেক বেশি মানুষের ওপর।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কোনো দেশই তা এককভাবে সমধান করতে পারবে না। কাজেই বিশ্বের প্রতিটি দেশকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ এবং এর অভিঘাত মোকাবিলার জন্য। সর্বাগ্রে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ দ্রুত ও বিজ্ঞান নির্দেশিত প্রচুর পরিমাণে কমিয়ে আনতে হবে। সুযোগের জানালা দ্রুতই সংকুচিত হয়ে আসছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বড়জোর এই দশকের বাকি সময় বিশ্ববাসীর হাতে রয়েছে। এই সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে প্রতিটি দেশকে তার দায় ও সক্ষমতার ভিত্তিতে একটি বৈশ্বিক সহযোগিতা কর্মসূচির আওতায় যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সম্পর্কে ইদানীং বেশ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সচেতনতা উল্লেখযোগ্য। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অনেকগুলো নীতি, পরিকল্পনা ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে, আর্থিক সামর্থ্যের কমতি ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকায়। তার পরও আমরা এক্ষেত্রে কাজ করে চলেছি। বাংলাদেশ গত তিন-চার বছর ধরে বছরে জাতীয় উত্পাদনের (জিডিপির) দেড় শতাংশের মতো (৫ থেকে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ব্যয় করছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। ঐ ব্যয় করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মাধ্যমে। বিদেশ থেকে সহায়তা পাওয়া যায় সামান্যই। এই সহায়তা আসে মূলত বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে, যার পরিমাণ বছরে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি নয়। সমস্যা গুরুতর, সেই বিবেচনায় অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন।
যেমন চলছে, তেমন চলতে থাকলে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যেমন বলেছেন, পৃথিবীর মানুষ এবং গোটা পৃথিবীটা এক অকল্পনীয় ধ্বংসলীলায় নিপতিত হতে পারে। লেখাটি শেষ করি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেসের এসংক্রান্ত দুটি উক্তি দিয়ে। তিনি ২৭তম জলবায়ু বিশ্ব সম্মেলনে (নভেম্বর ২০২২) বলেছেন, ‘আমরা জলবায়ু নরকের পথে মহাসড়কে আছি।’ এই জুলাই মাস (২০২৩) রেকর্ডকৃত সর্বাধিক উষ্ণ সময়, এটি বিবেচনায় রেখে তিনি সম্প্রতি আরো বলেছেন, ‘পৃথিবীর উষ্ণায়ন পর্ব শেষ, এখন স্ফুটন পর্ব শুরু’। তাই মুক্তির পথ রচনার লক্ষ্যে সারা বিশ্বকে একযোগে যার যার দায় ও সক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ বিজ্ঞান নির্দেশিত পরিমাণে এবং দ্রুততায় কমিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়নশীল বিশ্বে যে ব্যাপক বিরূপ অভিঘাত পড়ছে, তা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উন্নত বিশ্বকে প্রয়োজনীয় জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ভয়াবহ পরিস্থিতি মুখব্যাদান করে আছে, সেই ধ্বংসলীলা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ
Source: https://www.ittefaq.com.bd/ধ্বংসলীলা-বাস্তবে-রূপ-লাভ-করতে-পারে